ফ্যাসিজম কি?কোথায় প্রথম দেখা যায়? ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য.। কেন তাদের ফ্যাসিস্ট বলা হয়?





ফ্যাসিজম কি?কোথায় প্রথম দেখা যায়?
ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য.। কেন তাদের ফ্যাসিস্ট বলা হয়?






ফ্যাসিজম কি?
ফ্যাসিজম একটি রাজনৈতিক মতবাদ ও শাসনব্যবস্থা। এটি চরম জাতীয়তাবাদ, একনায়কতন্ত্র, এবং বিরোধী মত দমন করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ফ্যাসিবাদী শাসনে সাধারণতঃ—
ক) একনায়ক নেতা রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠেন।
খ) গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ও বিরোধী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে দমন করা হয়।
গ) রাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়।
ঘ) প্রচার, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
ঙ) সাধারণত বর্ণবাদ, শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেওয়া হয়।

কোথায় প্রথম দেখা যায়?
ফ্যাসিবাদ সর্বপ্রথম ইতালিতে দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ সালে বেনিতো মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আডলফ হিটলার জার্মানিতে নাৎসিবাদ নামে ফ্যাসিবাদের আরও ভয়াবহ রূপ সৃষ্টি করেন।
👉 সহজভাবে বললে, ফ্যাসিবাদ মানে হলো—একনায়কতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণের স্বাধীনতা হরণ করে রাষ্ট্র ও শাসকের পূজা করা হয়।

ফ্যাসিবাদের কারণ
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ → ইউরোপের অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দা, দারিদ্র্য ও অরাজকতা তৈরি হয়।
২. অর্থনৈতিক সংকট → বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের কারণে মানুষ স্থিতিশীল নেতৃত্ব চাইছিল।
৩. গণতন্ত্রের দুর্বলতা → দুর্বল ও অদক্ষ গণতান্ত্রিক সরকারে জনগণের আস্থা নষ্ট হয়।
৪. চরম জাতীয়তাবাদ → যুদ্ধ হেরে যাওয়া দেশগুলো নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চাইছিল।
৫. কমিউনিজমের ভীতি → ধনী শ্রেণি ও মধ্যবিত্তরা কমিউনিজমকে ভয় পেত, তাই তারা শক্তিশালী একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন দেয়।

ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য

১. একনায়কতন্ত্র → একজন নেতা সর্বশক্তিমান হন (যেমন মুসোলিনি, হিটলার)।
২. গণতন্ত্র বিরোধিতা → নির্বাচন, বহুদলীয় রাজনীতি ও স্বাধীন সংবাদপত্র বাতিল।
৩. চরম জাতীয়তাবাদ → নিজেদের জাতি ও দেশকে সবার উপরে ভাবা।
৪. সেনাবাদ → সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও যুদ্ধপ্রবণতা।
৫. প্রচারণা ও নিয়ন্ত্রণ → গণমাধ্যম, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছু শাসকের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৬. স্বাধীনতা দমন → বিরোধী মত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শ্রমিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন।
৭. বর্ণবাদ ও শ্রেষ্ঠত্ববাদ → বিশেষ জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার (যেমন নাৎসি জার্মানিতে "আর্য জাতি")।

ফ্যাসিবাদের প্রভাব
১. মানবাধিকার লঙ্ঘন → স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়।
2. সহিংসতা ও সন্ত্রাস → ভিন্নমতাবলম্বী, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্যাতিত হয়।
৩. যুদ্ধ ও ধ্বংস → ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে, যার ফলে কোটি মানুষ মারা যায়।
৪. অর্থনৈতিক বিপর্যয় → যুদ্ধ ও দমননীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা → ফ্যাসিবাদ পৃথিবীজুড়ে শান্তি নষ্ট করে দেয়।
👉 সংক্ষেপে বলা যায়:
ফ্যাসিবাদ উদ্ভব হয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী সংকট থেকে। এটি একনায়কতান্ত্রিক ও সহিংস মতবাদ, যা স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

ইতিহাসে যাদেরকে ফ্যাসিস্ট বলা হয়:

১. বেনিতো মুসোলিনি (ইতালি)
ফ্যাসিবাদের জনক।
১৯২২ সালে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখল করেন।
একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, বিরোধীদের দমন করেন, সেনাবাদ ও জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেন।

২. আডলফ হিটলার (জার্মানি)
নাৎসি পার্টির নেতা।
১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসেন।
“আর্য জাতি শ্রেষ্ঠ” এই তত্ত্ব প্রচার করেন।
ইহুদি ও সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালান (হলোকাস্ট)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল দায়ী ব্যক্তি।

৩. ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো (স্পেন)
স্পেনে গৃহযুদ্ধের পর ১৯৩৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন।
গণতন্ত্র ধ্বংস করে দীর্ঘ একনায়ক শাসন চালান।

৪. অ্যান্টোনিও সালাজার (পর্তুগাল)
পর্তুগালে একনায়কতান্ত্রিক শাসন (১৯৩২–১৯৬৮)।
ফ্যাসিস্ট ধাঁচে বিরোধীদের দমন করেন।

৫. হিদেকি তোজো (জাপান)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী।
আগ্রাসী সামরিক নীতি গ্রহণ করেন।
এশিয়ায় জাপানের আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ শুরু করেন।

কেন তাদের ফ্যাসিস্ট বলা হয়?

তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
চরম জাতীয়তাবাদ ও সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিলেন।
বিরোধী মত, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংখ্যালঘুদের দমন করেছিলেন।
জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রচারণা, ভয় ও সহিংসতা ব্যবহার করেছিলেন।
তাদের নীতির ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে।

👉 সহজভাবে বললে, ইতিহাসে মুসোলিনি, হিটলার, ফ্রাঙ্কো, সালাজার ও তোজো প্রমুখকে ফ্যাসিস্ট বলা হয়, কারণ তারা সবাই একনায়কতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সহিংসতা ও স্বাধীনতা দমনের মাধ্যমে রাষ্ট্র চালিয়েছিলেন।



No comments

Don't share any link

Theme images by rusm. Powered by Blogger.