সান্ডা কি?
সান্ডা (Monitor Lizard), যার বৈজ্ঞানিক গণনাম Varanus, হলো একটি বৃহৎ সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী। একে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ অঞ্চলে সান্ডা বা গুঁইসাপ নামে ডাকা হয়।
🌍 সান্ডার আদি নিবাস কোথায়?
সান্ডার (মনিটর লিজার্ডের) আদি নিবাস হলো:
✅ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,
✅ আফ্রিকা, এবং
✅ অস্ট্রেলিয়া।
এই অঞ্চলগুলোতেই প্রাচীনকাল থেকে মনিটর লিজার্ডের বিবর্তন ঘটেছে। Fossil বা জীবাশ্ম প্রমাণ অনুযায়ী, এদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৯ কোটি বছর আগে মধ্যক্রেটাশিয়াস যুগে অস্তিত্বে আসে।
🌎 পৃথিবীর কোন কোন দেশে কোন ধরনের সান্ডা দেখা যায়?
নীচে অঞ্চলভিত্তিক সান্ডার কিছু উল্লেখযোগ্য প্রজাতি দেওয়া হলো:
🇧🇩 বাংলাদেশ:
-
Bengal Monitor (Varanus bengalensis)
➤ সবচেয়ে সাধারণ প্রজাতি।
➤ ক্ষেত, বন ও বসতবাড়ির আশপাশে দেখা যায়।
➤ মাংসাশী, ছোট প্রাণী ও পোকামাকড় খায়।
🇮🇳 ভারত:
-
Varanus bengalensis (বেঙ্গল মনিটর)
-
Varanus salvator (Water Monitor, দক্ষিণ ভারতে দেখা যায়)
🇲🇾 মালয়েশিয়া ও 🇮🇩 ইন্দোনেশিয়া:
-
Water Monitor (Varanus salvator)
➤ আকারে বড়, জল ও স্থল উভয় জায়গায় চলাফেরা করে। -
Komodo Dragon (Varanus komodoensis)
➤ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতি।
➤ কেবল ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপপুঞ্জে পাওয়া যায়।
🇹🇭 থাইল্যান্ড ও 🇻🇳 ভিয়েতনাম:
-
Varanus salvator macromaculatus – পানিতে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণভাবে সাঁতারে পারদর্শী।
🌍 আফ্রিকা:
-
Nile Monitor (Varanus niloticus)
➤ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় প্রজাতি।
➤ নদী, জলাভূমি ও সাভানা অঞ্চলে বাস করে।
🇦🇺 অস্ট্রেলিয়া:
-
Perentie (Varanus giganteus)
➤ অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মনিটর লিজার্ড। -
Lace Monitor (Varanus varius)
🧾 সারসংক্ষেপ টেবিল:
দেশ / অঞ্চল | সান্ডার প্রজাতি | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
বাংলাদেশ | Bengal Monitor (V. bengalensis) | সাধারণ ও নিরীহ, ছোট প্রাণী খায় |
ভারত | Bengal Monitor, Water Monitor | গ্রামীণ ও বনাঞ্চলে দেখা যায় |
ইন্দোনেশিয়া | Komodo Dragon | বিশ্বের সবচেয়ে বড় সান্ডা |
আফ্রিকা | Nile Monitor | নদীমাতৃক অঞ্চলে বাস করে |
অস্ট্রেলিয়া | Perentie, Lace Monitor | মরুভূমিতে খাপ খাওয়া |
❗ গুরুত্বপূর্ণ:
-
সব সান্ডা বিষধর নয়, তবে কিছু প্রজাতির মুখে হালকা বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া থাকে।
-
অধিকাংশ সান্ডা লাজুক এবং মানুষের উপস্থিতি দেখলে পালিয়ে যায়।
নিচে সান্ডা (Varanus bengalensis) এবং গুইসাপ (Varanus salvator)—এই দুই প্রজাতির মনিটর লিজার্ডের আলাদা আলাদা ছবি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
🦎 সান্ডা (Varanus bengalensis)
ছবি:
বিবরণ:
-
বৈজ্ঞানিক নাম: Varanus bengalensis
-
সাধারণ নাম: সান্ডা, বেঙ্গল মনিটর
-
আবাসস্থল: বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল
-
আকার: দৈর্ঘ্যে প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত
-
আচরণ: স্থলচর, দিনে সক্রিয়, ছোট প্রাণী ও পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে
🦎 গুইসাপ (Varanus salvator)
বিবরণ:
-
বৈজ্ঞানিক নাম: Varanus salvator
-
সাধারণ নাম: গুইসাপ, ওয়াটার মনিটর
-
আবাসস্থল: বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ
-
আকার: দৈর্ঘ্যে ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত
-
আচরণ: জলচর ও স্থলচর উভয়ই, সাঁতার কাটতে দক্ষ, মাছ, ব্যাঙ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ইত্যাদি খায়
📊 তুলনামূলক ছক:
বৈশিষ্ট্য | সান্ডা (Varanus bengalensis) | গুইসাপ (Varanus salvator) |
---|---|---|
আকার | প্রায় ১ মিটার | ১.৫–২.৫ মিটার |
আবাসস্থল | স্থলচর, বনাঞ্চল, খোলা মাঠ | জলাশয়, নদীর পাড়, স্যাঁতসেঁতে এলাকা |
আচরণ | স্থলচর, দিনে সক্রিয় | জলচর ও স্থলচর উভয়ই |
খাদ্যাভ্যাস | পোকামাকড়, ছোট প্রাণী | মাছ, ব্যাঙ, ছোট স্তন্যপায়ী |
বিস্তৃতি | দক্ষিণ এশিয়া | দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া |
উল্লেখ্য: উভয় প্রজাতিই সাধারণত নিরীহ এবং মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়। তবে এদের বিরক্ত না করাই উত্তম।
আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে জানাতে পারেন।
নিচে সান্ডা ও গুইসাপের ছবি ও বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস (Scientific Classification) দেওয়া হলো, যাতে আপনি আরও পরিষ্কারভাবে তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন:
🦎 সান্ডা (Bengal Monitor) – Varanus bengalensis
✅ ছবি:
🔬 বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস:
শ্রেণি (Class) | Reptilia (সরীসৃপ) |
---|---|
বর্গ (Order) | Squamata |
উপবর্গ (Suborder) | Lacertilia |
পরিবার (Family) | Varanidae |
গণ (Genus) | Varanus |
প্রজাতি (Species) | Varanus bengalensis |
সাধারণ নাম | Bengal Monitor (সান্ডা) |
🦎 গুইসাপ – সাধারণত Varanus salvator বা Varanus bengalensis হিসেবেও বোঝানো হয়
✅ ছবি:
🔬 বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস:
শ্রেণি (Class) | Reptilia (সরীসৃপ) |
---|---|
বর্গ (Order) | Squamata |
উপবর্গ (Suborder) | Lacertilia |
পরিবার (Family) | Varanidae |
গণ (Genus) | Varanus |
প্রজাতি (Species) | Varanus salvator (জলচর গুইসাপ) বা V. bengalensis |
সাধারণ নাম | গুইসাপ / Water Monitor |
📝 সংক্ষেপে:
-
উভয়েই Varanus গণের সদস্য।
-
গুইসাপ অনেক সময় জলাশয়ে থাকে, তাই Water Monitor নামেও পরিচিত।
-
সান্ডা বেশি দেখা যায় খোলা জায়গায়, বন ও ঝোপঝাড়ে।
📌 দ্রষ্টব্য: ছবিগুলি উইকিমিডিয়া কমনস (Wikimedia Commons) থেকে নেওয়া হয়েছে এবং তা শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
সান্ডা (বা সান্ডা-গুইসাপ) নিয়ে বাংলার গ্রামীণ জীবনে অনেক প্রচলিত গল্প, প্রবাদ ও লোককথা রয়েছে। যদিও সান্ডা একটি নিরীহ সরীসৃপ, তবু লোকবিশ্বাসে এটি রহস্যময়, অলৌকিক বা ওষুধি ক্ষমতার প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
🔶 বাংলার প্রচলিত গল্প ও বিশ্বাস:
-
সান্ডার তেল:
বহু যুগ ধরে বাংলার গ্রামে একটি বিশ্বাস চালু আছে—সান্ডার তেল খুব মূল্যবান এবং এটি খাওয়া বা মালিশ করলে পুরুষত্ব বাড়ে ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। যদিও এই বিশ্বাসের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবুও বহু বছর ধরে এই গল্পটি প্রচলিত। -
গুইসাপ ও সান্ডার পার্থক্য নিয়ে বিভ্রান্তি:
অনেকেই মনে করে গুইসাপ আর সান্ডা এক প্রাণী। কিন্তু প্রচলিত লোককথায় সান্ডাকে ‘ভালো’ আর গুইসাপকে ‘খারাপ’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়—যেমন সান্ডা নিরীহ, আর গুইসাপ বিষধর। -
সান্ডার হঠাৎ দেখা:
গ্রামীণ এলাকায় অনেক সময় বলা হয়—“যেদিন সান্ডা চোখে পড়ে, সেদিন অদ্ভুত কিছু ঘটবে।” অনেকে এটাকে ভাগ্যের পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন।
🔷 সান্ডা নিয়ে প্রবাদ ও খনার বচন:
✦ বাংলা প্রবাদ:
-
"সান্ডার দৌড়, বালির চোরা"
অর্থ: অকারণে ভয় দেখানো, কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু নয়। -
"সান্ডা না দেখলে বোঝা যায় না তার গর্ত কত গভীর"
অর্থ: বাইরের চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না, গভীরে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে।
✦ খনার বচনের ছায়ায় রচিত লোকবচন:
-
"সান্ডা বাসে শুষ্ক মাটে, গাছ ঝরে তাতে পাতি পাতি।
সে বৎসর ধান জমে, গোলা ভরে খাটি খাটি।"
অর্থ: সান্ডা যদি শুষ্ক স্থানে বাসা বাঁধে, তবে সে বছর বৃষ্টি হবে, এবং ফসল ভালো হবে।
বাংলা সমাজে “সান্ডা” শব্দটি মূলত একটি প্রাণীর নাম হলেও অনেক সময় এটি রূপক অর্থে বা বিদ্রূপ হিসেবে মানুষকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি অপ্রচলিত বা আঞ্চলিক গালিমূলক শব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে, এবং সাধারণত নীচের অর্থে ব্যবহৃত হয়:
🔶 সমাজে কাদেরকে "সান্ডা" বলা হয়?
1. বোকার মতো চুপচাপ থাকা মানুষ
যে ব্যক্তি সব সময় চুপচাপ থাকে, নিজের মত প্রকাশ করে না, তাকে অনেক সময় বলা হয়:
🗣️ “সান্ডার মতো চুপ করে বসে আছিস কেন?”
2. ধীরগতির বা অলস মানুষ
কেউ খুব ধীর, অলস ও কর্মবিমুখ হলে বিদ্রূপ করে বলা হয়:
🗣️ “ও তো একেবারে সান্ডা—না কাজ করে, না নড়ে।”
3. অপ্রতিক্রিয়াশীল বা নির্লজ্জ ব্যক্তি
যে মানুষ অপমান সহ্য করে চুপ করে থাকে বা যার মধ্যে আত্মমর্যাদা কম, তাকেও কখনো বিদ্রুপ করে বলা হয়:
🗣️ “তাকে যা খুশি বল, সান্ডার মতো মুখ গুঁজে থাকবে।”
4. ভুলভাবে জ্ঞানের দাবি করা মানুষ
কেউ যদি নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করে, অথচ প্রকৃত জ্ঞান থাকে না, তাহলে হাস্যরস করে বলা হয়:
🗣️ “বিজ্ঞানের সান্ডা!”
⚠️ সতর্কতা:
“সান্ডা” শব্দটি আপত্তিকর ও অবমাননাকর অর্থে ব্যবহার করা হলে তা অন্যকে কষ্ট দিতে পারে বা অপমানজনক হতে পারে। তাই এই ধরনের শব্দ ব্যবহারে সংযম ও প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরি।
✅ রূপক অর্থে "সান্ডা" ব্যবহার উদাহরণ:
🔸 “শুধু চুপ করে বসে থাকলেই হবে না, সান্ডা না হয়ে একটু মানুষ হ।”
🔸 “তুই কি সান্ডা হইছিস, মুখে কথা নাই কেন?”
🔶 সমাজে কাদেরকে "সান্ডা" বলা হয়?
🔸 “শুধু চুপ করে বসে থাকলেই হবে না, সান্ডা না হয়ে একটু মানুষ হ।”
🔸 “তুই কি সান্ডা হইছিস, মুখে কথা নাই কেন?”
No comments
Don't share any link